বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদ : ধর্মীয় উৎসব ও আমাদের মহাসম্মিলন

ঈদ : ধর্মীয় উৎসব ও আমাদের মহাসম্মিলন

মানব সমাজে উৎসবের শুরুটা কীভাবে হয়েছিলো তার নির্দিষ্ট সূত্র টানা কঠিন। তবে এর সাথে জীবনের আনন্দ, সফলতা ভাগ করে নেওয়ার যে একটা সংযোগ ছিলো সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আদিম মানুষ যখন শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো, নিশ্চিতভাবেই একটা ভালো শিকার অভিযান তাদের মনে এক ধরনের আনন্দের অনুভূতি তৈরি করতো। উৎসব ছিলো সেই আনন্দ উদযাপানের মাধ্যম।

ধর্মীয় বিশ্বাসের উন্মেষ, বিকাশ এবং প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ উৎসবে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বরে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমও হয়ে ওঠে কিছু নির্দিষ্ঠ উৎসব। প্রাচীন গ্রীসে এবং অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতায় এ ধরনের ধর্মীয় উৎসবের বেশুমার উদাহরণ রয়েছে।

সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন উৎসব যোগ হয়েছে, কিছু পুরনো উৎসব বিলীন হয়েছে। কিন্তু সমাজে উৎসবের উপস্থিতি নিত্যই রয়ে গেছে।

উৎসবের এর একটা বড় দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে আধুনিক সময়ের ফিলিপাইনে। দেশটিতে বছরের প্রতিদিন কোনো না কোনো উৎসব পালন করা হয়। প্রায় ৪২ হাজার ছোট-বড় উৎসব উদযাপন করা হয় বছর জুড়ে।

উৎসবের উদ্ভবটা যেহেতু মানুষে মনস্তত্ত্বের সঙ্গেই নিহিত তাই অবচেতন বা সচেতন মনে এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর।

আমাদের জীবনে উৎসব যে কত গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোধ হয় এই করোনা সংকট খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। মাসের পর মাস ঘরে থেকে কিংবা সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দিতে না পেরে দিন-রাত সব একাকার হয়ে গেছে।

উৎসবের ব্যাপারটা এতটাই সঙ্গীন যে সপ্তাহের দিন, বার, তারিখ এগুলোও ঠিক খেয়াল রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। উৎসব উপলক্ষ্যগুলো ছিলো আমাদের জীবনের অবিরাম চলমান সময়ের এক একটা যতিচ্ছেদ- কোনোটা ছোট, অল্প আনুষ্ঠানিকতার; আবার কোনোটা বৃহৎ আয়োজনে আড়ম্বড়পূর্ণ।

মুসলিম সমাজের জন্য সবচেয়ে আড়ম্বড়পূর্ণ উৎসব দুটি- বছরের দুই ঈদ। কিন্তু এর বাইরেও সপ্তাহের প্রতি শুক্রবারকে একটা বিশেষ দিন হিসেবে আলাদা করা যায়। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এক একটা শুক্রবার মুসলমানদের জন্য এক একটা 'মিনি' ঈদ। যেমন- ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতের জন্য কথাটা সত্য। তেমনি একটু বিশেষ খাবার, সমাজের আরও দশজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত হওয়া কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের আপ্যায়ন; এসব মিলে শুক্রবারগুলো বিশেষ একটা উপলক্ষ্য। ধর্মীয় এবং সামাজিক উভয় দিক থেকেই।

ইসলামের উৎসবগুলোর একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সব মানুষকে শামিল করার একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এতে নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। শুক্রবার বেশি বেশি দান করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। ঈদুল ফিতরের সময় (বিশেষ করে খাদ্য-দ্রব্য) ফিতরা দেয়ার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা এবং ঈদুল আজহার সময়ে কুরবানি, জাকাত ইত্যাদি দেয়ার অনুশাসনগুলো সমাজের সবশ্রেণির মানুষকে একই আনন্দে, একই উৎসবে অবগাহন করার সুযোগ করে দেয়।

অন্যান্য ঐতিহ্যগত উৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় উৎসবের এখানেই একটি বড় পার্থক্য লক্ষণীয়। যেমন- পহেলা বৈশাখ উদযাপনকালে কেউ কাউকে নতুন কিছু কিনে দিতে বাধ্য নয়। অভুক্ত প্রতিবেশিকে খাবার দেয়ার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই।

কিন্তু ঈদ! ঈদের উৎসবে সব কিছু নির্ধারিত। ঈদের উৎসবে যে অভাবে আছে, যে কুরবানি করতে পারেনি, যার ঘরে খাবার নেই, তার জন্য (তাদের অধিকার স্বরূপ) সামর্থ্যবানদের প্রতি সুনির্দিষ্ট নিয়ম করে দেয়া হয়েছে।

ঈদুল ফিতর কিংবা ঈদুল আজহার উৎসবের এই হচ্ছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই বিষয়টা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই মহিমান্বিত হবে ধর্মীয় উৎস, ঈদ উৎসব। সর্বোপরি এ উৎসব হবে আমাদের মহাসম্মিলন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযু্ক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দৈনিক বগুড়া