সোমবার, ১৭ জুন ২০২৪, ৩ আষাঢ় ১৪৩১

অহেতুক ব্যয়বহুল প্রকল্প আর নয়

অহেতুক ব্যয়বহুল প্রকল্প আর নয়

সংগৃহীত

সার্বিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতার কথা মাথায় রেখে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন থেকে অহেতুক ব্যয়বহুল আর কোনো প্রকল্প নেওয়া যাবে না। অপ্রয়োজনীয় সব প্রকল্প পরিহার করতে হবে। মনোযোগ বাড়াতে হবে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত করা যায় এমনসব প্রকল্পের দিকে। 

সম্প্রতি সচিব সভায় বিভিন্ন বিষয়ে ৩৪টি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের তাগাদাও দেওয়া হয়েছে। গত ৭ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ নির্দেশনা-সংবলিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, উন্নয়নের অর্থ কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়। সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত হওয়াই হলো প্রকৃত উন্নয়ন। প্রকল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কতটা উপকারে আসবে বা কি সুফল পাওয়া যাবে তা বিবেচনায় নিতে হবে। এছাড়া প্রকল্প থেকে কতদিনে সুফল আসতে পারে সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ পরিহার করতে হবে। অহেতুক ব্যয়বহুল প্রকল্প নেওয়া যাবে না। অন্যদিকে যেসব অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে বা যে সকল উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ সাধিত হয়েছে সেগুলো যেন টেকসই হয়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। যে সকল প্রকল্প অল্প ব্যয় করলেই সমাপ্ত হয়ে যাবে, সেগুলো দ্রুত বরাদ্দ দিয়ে বাস্তবায়নকাজ শেষ করতে হবে। 

নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, রপ্তানি বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে আসবাবপত্র, পাটজাত দ্রব্য, হস্ত-কারুশিল্পকে পোশাক শিল্পের মতো সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। সুনীল অর্থনীতির আওতায় সমন্বিতভাবে সমুদ্রের সম্পদ আহরণের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। শূন্যপদে নিয়োগের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। নিয়মিত পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। পদোন্নতির সময় নারী কর্মকর্তারা যেন অন্যায়ভাবে বঞ্চিত না হন, সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রথাগত আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে অতিক্রম করে সংবেদনশীল ও জনমুখী প্রশাসন গড়ে তুলতে সকল পদক্ষেপ নিতে হবে। অতি দারিদ্র্যের হার শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাদেরকে ঘর করে দেওয়া হয়েছে তাদেরকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এক কথায় আত্মপ্রত্যয়, আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে হবে। 

সূত্র জানায়, গুরুত্বপূর্ণ ওই সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রী যে ৩৪টি নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো মন্ত্রিপরিষদ সচিব স্বাক্ষরিত চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ৪টি স্তম্ভ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑ স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ গঠন নিশ্চিত করতে নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের করণীয় চিহ্নিত করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণপূর্বক তা বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতীয় সংসদের কার্যক্রমে যথাযথভাবে সহায়তা করতে হবে। আইন-প্রণয়ন পদ্ধতি ও সংসদের কার্যপ্রণালীসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তরে যথাযথভাবে সহায়তা করতে হবে। প্রশ্নোত্তর পর্বে সংসদে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়/বিভাগের কার্যক্রম চিহ্নিত করে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রগতি নিয়মিত পরিবীক্ষণ করতে হবে।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে মূল্যস্ফীতি হ্রাসে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। মূল্যস্ফীতির হার যেন প্রবৃদ্ধির হারের নিচে থাকে সে লক্ষ্যে সমম্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি এবং বাজার ব্যবস্থা নিয়মিত পরিবীক্ষণ করতে হবে। সমম্বিতভাবে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে। এছাড়া পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে করজাল (ট্যাক্স নেট) সম্প্রসারণ করতে হবে। কেউ যেন কর ফাঁকি দিতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থল ও সমুদ্র বন্দরগুলোকে অটোমেশন করতে হবে। কর-ভ্যাট-শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার সব ধরনের অপচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। বিনিয়োগ বৃদ্ধির অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেন সহযোগিতার অভাবে ফেরত না যায় তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ করা এবং কোনো প্রতিকূলতা থাকলে তা দ্রুত দূর করতে হবে।

নির্দেশনাসমূহের মধ্যে আরও উল্লেখ রয়েছেÑ সরকারি ব্যয়ে মিতব্যয়ী হতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা যাতে অযথা ব্যয় না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও নতুন বাজার খুঁজতে হবে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ, জাপান, কোরিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চল বা দেশে রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। জুট জেনোম আবিষ্কার হওয়ায় পাটের বহুমুখী ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছেÑ এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাট ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।

সচিব সভার কার্যপত্র সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী ওই সভায় খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সকলকে আন্তরিক হতে বলেছেন। অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, এক্ষেত্রে বিশেষভাবে চরাঞ্চলে বাদাম, শস্যসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে ভোজ্য তেলের আমদানি কমাতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে তিলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তিল চাষ বৃদ্ধি করতে পারলে রপ্তানির সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। কোনো অবস্থাতেই তিন ফসলি জমি নষ্ট করা যাবে না, সেদিকে কর্মকর্তাদের নজর রাখতে হবে। খাদ্য, সবজি এবং অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পকে সহায়তা করতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে। সেচযন্ত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শিল্প-কারখানায় সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হবে।

কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সার্ভিস সেক্টরে সার্টিফিকেট কোর্সসহ মানসম্মত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যুগের পরিবর্তন ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। বইমেলাকে ক্রমান্বয়ে উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কিশোর গ্যাং এবং ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা নিতে হবে। শিশু-কিশোররা নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে কি না তা পরিবীক্ষণ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে সামরিক শাসনামলে জারি করা অধ্যাদেশগুলোর মধ্যে যে ১৬টি আইনের এখনও বিযুক্তিকরণ সম্পন্ন হয়নি, সেগুলো বিযুক্তিকরণ করতে হবে। 

প্রধানমন্ত্রী সচিবদের উদ্দেশে আরও বলেন, শূন্যপদে নিয়োগের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। নিয়মিত পদোন্নতিও নিশ্চিত করতে হবে। পদোন্নতির সময় নারী কর্মকর্তারা যেন অন্যায়ভাবে বঞ্চিত না হন, সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে। পানিপ্রবাহ সংরক্ষণ ও সংস্কার করতে হবে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বা অন্য কোনো কারণে নদীর পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। সেচের কাজে ভূগর্ভস্থ পানির বদলে ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সুনীল অর্থনীতির আওতায় সমন্বিতভাবে সমুদ্রের সম্পদ আহরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। পর্যটন বিকাশে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। দুর্নীতি দমন শুধু দুর্নীতি দমন কমিশনের একার কাজ নয়, এ বিষয়ে সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারি সকল সেবা অনলাইনভিত্তিক করতে হবে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন এ বিষয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনা ও সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের জন্য সচিবদের ব্যক্তিগত মনোযোগ আকর্ষণ করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের কাজ কতদূর সম্পন্ন হয়েছে, সে বিষয়ে জানাতে বলা হয়েছে। 

এ বিষয়ে একাধিক সচিবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠি পাওয়ার পর তারা কার্যক্রম শুরু করেছেন। সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তারা নির্দেশনা দিয়েছেন। সকল জটিলতা দূর করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারবেন বলেও তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

সূত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ

সর্বশেষ: